সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

পরস্পরে সম্বোধন ও ব্যবহার

শায়খ সালাহ বিন মুহাম্মদ আল বুদাইর:

মানুষের সঙ্গে কথোপকথন একটি অপরিহার্য যোগসূত্র। যাতে জ্ঞানার্জন, বিবেক-বুদ্ধির পূর্ণতা, অন্তরের প্রশান্তি এবং দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় নিহিত। পারস্পরিক সম্বোধনে উত্তম কথোপকথন, সুন্দর কথামালা, মহৎ চরিত্র, শ্রেষ্ঠতর গুণ ও সুউচ্চ মর্যাদা অন্তর্ভুক্ত। সম্বোধিত ব্যক্তি কিংবা শ্রোতাদের সম্মানার্থে যে ব্যক্তি তার কথাকে অলংকৃত করে, বাণীকে সাজিয়ে বলে, ভাষাকে পরিমার্জিত করে, বক্তব্যকে শোভিত করে এবং ভাষণকে সুসজ্জিত করে; মানুষের ভালোবাসাপূর্ণ অন্তর ও প্রীতিপূর্ণ হৃদয় তার অনুগত হয়। মহান আল্লাহ মানুষের অন্তরকে শ্রুতিমধুর ও মিষ্টি ভাষায় সম্বোধনকারীর প্রতি ভালোবাসার সহজাত বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অনুরূপভাবে কটুভাষী ও গালিবাজের প্রতি অসন্তোষ, অশ্লীল ও বেপরোয়া ভাষা ব্যবহারকারীর প্রতি ঘৃণার জন্মগত বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন।

নম্র ভাষা হৃদয়ের মধ্যে লুকায়িত বিদ্বেষ ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেয়। মিষ্টি কথা প্রতিটি বঞ্চিত, আহত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা দেয়। হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ভালো কথা বলা সদকা সমতুল্য।’ -সহিহ বোখারি

সুতরাং মানুষকে সম্বোধন করুন এমন ভাষায় যা সর্বোত্তম, অতি সুন্দর ও কোমল। যে ভাষা হীনতা, অশ্লীলতা ও কর্কশতা থেকে দূরে এবং সম্বোধনকৃত ব্যক্তিকে কষ্ট প্রদান, অবমাননা ও হেয়প্রতিপন্ন করে না। আপনার ভাষাকে এমন শব্দ ব্যবহার থেকে মুক্ত রাখুন, যা শ্রোতাকে বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা এবং মর্যাদাহানি করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে সদালাপ করবে।’ -সুরা আল বাকারা: ৮৩

বলা হয়, যুদ্ধের সূচনা হয় কথার মাধ্যমে আর সমাপ্তি ঘটে ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে। বড় অনিষ্টের শুরু হয় তুচ্ছ কারণ থেকে। তেমনি যুদ্ধের সূচনা হয় কথার লড়াই দ্বারা। ব্যক্তি জিহ্বা দিয়ে তা-ই উচ্চারণ করে, যা তার অন্তরে লালন করে; ভালো হলে ভালো, আর খারাপ হলে খারাপ। মানুষের জিহ্বা তার অন্তরের চাবি, সে যা গোপন রাখেÑ মুখ তা প্রকাশ করে। মুহাম্মাদ বিন আলী বলেন, ‘ইতর ব্যক্তির অস্ত্র হলো নিকৃষ্ট কথা।’

যাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় শব্দ চয়নে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, তারা হলেন পিতামাতা। পিতামাতার উচ্চ মর্যাদা, সম্মান ও অধিকারের কারণে তাদের সম্বোধনের সময় সুন্দর শব্দের মাধ্যমে উত্তম অর্থ সংবলিত বাক্য ব্যবহার করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের উফ্ বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না। আর তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো।’ -সুরা বনি ইসরাঈল: ২৩

বর্ণিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা বিরক্তি ও অসন্তুষ্টিসূচক ‘উফ্’ শব্দ দ্বারা তাদের সম্বোধন করতে নিষেধ করেছেন। তাদের সঙ্গে সুন্দর কথা বলতে আদেশ করেছেন যা সদাচরণ এবং তাদের অধিকার, হক ও মর্যাদা সংরক্ষণের প্রতি আহ্বান করে। তাদের নাম ধরে ডাকবে না, তাদের উপস্থিতিতে অযথা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলবে না। কেননা তা দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণের শামিল। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) পিতার হক সম্পর্কে বলেন, ‘তাকে নাম ধরে ডাকবে না, তার সামনে হাঁটবে না এবং তার আগে বসবে না।’ – আদাবুল মুফরাদ

সম্বোধনের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। স্ত্রীদের বলা হয়েছে, আপনার স্বামী আপনার আশ্রয়, ছায়া, শক্তি ও সুখের দ্বার। কাজেই তাকে এমনভাবে সম্বোধন করবেন না, যা তাকে কষ্ট দেয়। অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে তাকে রাগান্বিত করবেন না। তাকে সম্মান করুন ও মর্যাদা দিন। সেই সঙ্গে স্বামীদের বলা হয়েছে, আপনার স্ত্রী আপনার সহধর্মিণী ও সঙ্গিনী। সে আপনার কাছ থেকে উপকার, সমর্থন, নম্রতা ও নিরাপদ শব্দ প্রত্যাশা করে। কাজেই তার সঙ্গে কথা বলার সময় স্নেহমাখা, আনন্দদায়ক, সম্মানজনক ও কোমল বাক্য ব্যবহার করুন। তাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে লাঞ্ছিত করবেন না, তিরস্কার, নিন্দা ও ভর্ৎসনা দ্বারা বিরক্ত করবেন না এবং তালাক ও বিচ্ছেদের হুমকি দিয়ে আতঙ্কিত করবেন না।

পিতামাতাদের ক্ষেত্রে ইসলামের পরামর্শ হলো, সন্তান অন্তরের ফল ও হৃদয়ের সুগন্ধি। কাজেই তাদের নম্রতা, দয়া, সহানুভূতি, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের আহ্বান শোনান। তাদের উৎসাহ, উদ্বুদ্ধ, আকর্ষণ ও তৃপ্তির বাণী শোনান। যে ব্যক্তি তার সন্তানকে নির্বোধ, বোকা, উদাসীন ও উদ্ভট বলে আখ্যায়িত করে, সে মূলত সুষ্ঠু প্রতিপালনের পরিপন্থী দুর্ব্যবহারমূলক আচরণ করল; যদিও সে শব্দগুলো হারাম পর্যায়ের নয়। কোনো পিতার জন্য সমীচীন নয়, সে তার সন্তান ও পরিবারের জন্য গালমন্দ ও অভিশাপকারী হবে। কোনো কোনো বিদ্বানের মতে, শরিয়ত পরিপন্থী শব্দ ব্যবহারে যে ব্যক্তি স্বীয় সন্তান ও পরিবারকে গালমন্দে অভ্যস্ত হবে, তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে এবং সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যাত হবে।

সন্তানের হেদায়েত, তওফিক ও সততার জন্য দোয়া করা উচিত। তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করা উচিত নয়। কোনো কোনো বাপ-মা রয়েছেন, যারা অদূরদর্শিতা, অস্থিরতা ও ধৈর্যহীনতার কারণে বিরক্তি ও ক্রোধের সময় নিজের এবং পরিবার ও সন্তানের বিরুদ্ধে ত্বরিত মৃত্যু ও ধ্বংসের বদদোয়া করেন। অনুরূপভাবে এমন কিছু দোয়া করেন, যা কবুল হওয়া তিনি পছন্দ করেন না। যদি তার কল্যাণের দোয়ার মতো বদদোয়াগুলো কবুল হতো তাহলে সে ধ্বংস হয়ে যেত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষ অকল্যাণের দোয়া করে, যেমন তার দোয়া হয় কল্যাণের জন্য আর মানুষ অতি ত্বরাপ্রবণ।’ -সুরা বনি ইসরাঈল: ১১

হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের ওপর, সন্তানদের ওপর ও নিজের ধন-সম্পদের ওপর বদদোয়া করবে না। এমন যেন না হয় যে, তোমরা এমন মুহূর্তে বদদোয়া করছো- যখন আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া হলে তিনি তা কবুল করেন।’ -সহিহ মুসলিম

উপদেশ যখন উত্তম ও সহজ শব্দ দ্বারা হয়, তখন তা অন্তরের জন্য সুমিষ্ট ও মন আকৃষ্টকারী হয়। যখন তা উচ্চ বৈশিষ্ট্য দ্বারা প্রকাশ করা হয়, সুন্দর অর্থে সজ্জিত করা হয় তখন শ্রবণশক্তি ও মন তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ত্রুটিকারীদের ভয় ও নিরাশার সুরে সম্বোধন করবেন না, তাদের সঙ্গে বিরক্তিভাব নিয়ে সাক্ষাৎ করবেন না। বরং বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা ও উৎসাহের বাণী শোনান। মনে রাখবেন, নরম কথা ঔদ্ধত্য আচরণকারীর ধৃষ্টতার দেয়ালকে চুরমার করে দেয় এবং সীমালঙ্ঘনকারীর কঠোরতাকে কোমল করে।

তাই উচ্চ সম্মান ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে উপযুক্ত বাক্যের মাধ্যমে সম্বোধন করা উচিত। উত্তম শিষ্টাচারের অন্তর্গত হলো মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে জানা আর তাদের সঙ্গে যথোপযুক্ত মেলামেশা ও বাক্য ব্যবহার করা। যে ব্যক্তির ভাষা খারাপ, আচরণ মন্দ, বাচাল প্রকৃতির এবং গুণীজনদের মানহানির ব্যাপারে উদগ্রীব; তাকে মানুষেরা অপছন্দ করে এবং বন্ধু-বান্ধবরা পরিত্যাগ করে। হজরত আবু উসমান (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজে মর্যাদাবান হয়, সে অন্যের মান-মর্যাদা বুঝতে পারে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আত্মমর্যাদাহীন হয়, সে অন্যের মর্যাদাকে ছোট করে দেখে।’

হে মুসলিমরা! পেশাগত ক্ষেত্রে সমকক্ষ, সহকর্মী এবং ব্যবসায়িক অঙ্গনে অংশীদারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাষায় সম্বোধন করা উচিত, শত্রুতাপূর্ণ ভাষায় নয়। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা উচিত নিকটজনের ভাষায়, কর্র্তৃত্ববাদী ভাষায় নয়। এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যে তার সঙ্গী ও সমকক্ষকে ইচ্ছাকৃতভাবে মন্দ ভাষায় সম্বোধন করে। সহকর্মীর সঙ্গে জনসম্মুখে বিবাদে লিপ্ত হয়, মর্যাদাহানি ও অবমূল্যায়নের উদ্দেশ্যে, সহকর্মীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে হেয় করে। এগুলো দাম্ভিক, স্বৈরাচার, কর্র্তৃত্ববাদী, লোলুপ ব্যক্তির কর্মকাণ্ড। এগুলো ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, ধোঁকা ও মোনাফিক ব্যক্তির স্বভাব, যা কোনো আদর্শবান ব্যক্তির চরিত্র নয়।

২৩ সেপ্টেম্বর মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION